বিলিয়ারি সিরোসিস, যা বর্তমানে প্রাইমারি বিলিয়ারি কোলাঙ্গাইটিস (Primary Biliary Cholangitis - PBC) নামে পরিচিত, একটি দীর্ঘস্থায়ী লিভারের রোগ। এটি একটি অটোইমিউন রোগ যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুলবশত লিভারের ছোট পিত্তনালী (bile ducts) আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে ধ্বংস করে। এই পিত্তনালীগুলি লিভার থেকে ক্ষুদ্রান্তে পিত্ত (bile) প্রবাহিত করে, যা চর্বি এবং অন্যান্য খাদ্য উপাদান হজম করতে সহায়ক। যখন এই পিত্তনালীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ধ্বংস হয়ে যায়, তখন পিত্ত লিভারে জমা হয়, যা লিভারের কোষ ধ্বংস করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত লিভারের সিরোসিস বা ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।
বিলিয়ারি সিরোসিসের লক্ষণগুলি প্রাথমিক পর্যায়ে খুবই মৃদু হতে পারে এবং সময়ের সাথে সাথে ক্রমশ তীব্র হয়। এখানে কিছু সাধারণ লক্ষণ উল্লেখ করা হলো:
এটি সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ। রোগীরা প্রায়ই প্রচণ্ড ক্লান্তি এবং দুর্বলতা অনুভব করেন, যা দৈনন্দিন কাজকর্মকে প্রভাবিত করতে পারে।
চুলকানি এই রোগের আরেকটি সাধারণ লক্ষণ। এটি সাধারণত হাত, পা, এবং পুরো শরীরে হতে পারে এবং রাতে বেশি তীব্র হয়।
লিভার যখন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, তখন বিলিরুবিন নামে এক ধরনের পদার্থ রক্তে জমা হয়, যা ত্বক এবং চোখের সাদা অংশে হলুদভাব সৃষ্টি করে।
লিভারের ফোলা বা ক্ষতির কারণে পেটের ডান পাশে ব্যথা হতে পারে। এটি কখনও কখনও তীব্র হতে পারে এবং নড়াচড়ার সময় ব্যথা বাড়তে পারে।
বিলিয়ারি সিরোসিসের কারণে শুষ্ক চোখ এবং মুখের সমস্যা হতে পারে। এই লক্ষণটি Sjögren's syndrome নামক আরেকটি অটোইমিউন অবস্থার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।
লিভারের কার্যক্ষমতা কমে গেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ফ্লুইড জমা হতে পারে, বিশেষ করে পায়ের গোড়ালি, পা, এবং পেটে।
বিলিয়ারি সিরোসিসের কারণে পুষ্টির অভাব দেখা দিতে পারে, যার ফলে ওজন কমে যায়।
বিলিয়ারি সিরোসিসের সঠিক কারণ এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি, তবে এটি একটি অটোইমিউন রোগ হিসাবে বিবেচিত হয়। এখানে কিছু সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করা হলো:
বিলিয়ারি সিরোসিসে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুলভাবে লিভারের পিত্তনালী আক্রমণ করে, যা ধীরে ধীরে এই নালীগুলিকে ধ্বংস করে।
এই রোগে জেনেটিক্সের ভূমিকা থাকতে পারে। পারিবারিক ইতিহাস থাকলে এই রোগের ঝুঁকি বেশি হতে পারে। কিছু জেনেটিক পরিবর্তন এই রোগের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিবেশগত উপাদান যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, বা টক্সিনের সংস্পর্শ এই রোগের সূচনা ঘটাতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
বিলিয়ারি সিরোসিস প্রায়ই অন্যান্য অটোইমিউন রোগগুলির সাথে সম্পর্কিত থাকে, যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, স্ক্লেরোডার্মা, এবং Sjögren's syndrome।
বিলিয়ারি সিরোসিসের জন্য সম্পূর্ণ নিরাময়ের চিকিৎসা নেই, তবে এর লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণ এবং রোগের অগ্রগতি ধীর করার জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে:
উরসোডিওক্সিকোলিক এসিড (Urso): এটি একটি সাধারণ ওষুধ যা পিত্ত প্রবাহকে উন্নত করতে এবং লিভারের ক্ষতি কমাতে সহায়ক। এটি বিলিয়ারি সিরোসিসের রোগীদের মধ্যে লিভারের কার্যক্ষমতা উন্নত করে।
অবিটিচোলিক এসিড (Obeticholic Acid): এটি একটি নতুন ধরনের ওষুধ যা লিভারের ক্ষতি ধীর করতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যদি উরসোডিওক্সিকোলিক এসিড যথেষ্ট কার্যকর না হয়।
ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ: কিছু ক্ষেত্রে, ইমিউন সিস্টেমের কার্যকলাপ কমাতে ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি লিভারের আক্রমণ কমিয়ে দিতে পারে।
ভিটামিন এবং ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট: পিত্ত প্রবাহে ব্যাঘাতের কারণে কিছু ভিটামিন এবং পুষ্টি উপাদান শোষণ কমে যেতে পারে। তাই, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, এবং অন্যান্য ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ প্রয়োজন হতে পারে।
পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ: হজম এবং পুষ্টি শোষণের ক্ষমতা উন্নত করার জন্য সুষম এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ লিভারের স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক হতে পারে।
অ্যালকোহল পরিহার করা: অ্যালকোহল লিভারের ক্ষতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে, তাই এটি সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা উচিত।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: রোগের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য নিয়মিত লিভারের পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
যদি লিভারের ক্ষতি খুবই তীব্র হয় এবং অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকর না হয়, তবে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট একমাত্র বিকল্প হতে পারে। এটি একটি গুরুতর এবং জটিল প্রক্রিয়া হলেও, এটি জীবনের মান উন্নত করতে এবং রোগীর সুস্থতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।
বিলিয়ারি সিরোসিস বা প্রাইমারি বিলিয়ারি কোলাঙ্গাইটিস (PBC) একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং অটোইমিউন লিভারের রোগ। যদিও এটি সম্পূর্ণরূপে নিরাময়যোগ্য নয়, তবে সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগের অগ্রগতি ধীর করা এবং লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকা, সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই রোগের প্রভাব কমাতে সহায়ক হতে পারে।